-এ্যাডভোকেট আলহাজ¦ মোঃ আব্বাস উদ্দিন :
বাজেট হলো কোন সরকারের বাৎসরিক আয়-ব্যয়ের হিসাব। যদিও আধুনিক বাজেটের যাত্রা শুরু ১৭৩৩ সালে বৃটেনে। আর আমাদের ভারত উপ-মহাদেশ বৃটিশ উপনিবেশিক আমলে ১৮৬১ সালে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৭-৪৮ সালে তথা পাকিস্তান আমলে এবং আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশে বাজেটের যাত্রা শুরু ১৯৭২-১৯৭৩ অর্থ বছর থেকে। আর অমাদের প্রথম অর্থ বছরের বাজেটের পরিমান ছিলো ৭৮৬ কোটি টকা। কালের বিবর্তনে আর্থিক উন্নয়নের হাত ধরে আমাদের বর্তমান ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ঘোষিত বাজেটের পরিমান- ৬,০৩,৬৮১ কোটি টাকা। আমাদের জাতীয় প্রথম বাজেট সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশের এর পরিমান ছিলো-মাথা পিছু ১০৪.৮০ টাকা, আর বর্তমাটে বাজেট এ ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশে- এখন মাথা পিছু বাজেট ৩৫,৫১০.৬৫ টাকা!
এ মেগা বাজেটের আর্থিক উৎস নি¤œরূপঃ-
১। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত করসমূহ= ৩,৩০,০০০/= কোটি টাকা।
২। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রন বহির্ভূত কর= ১৬,০০০/= কোটি টাকা।
৩। কর বহির্ভূত আয়- ৪৩,০০০/= কোটি টাকা।
৪। বৈদেশিক অনুদান- ২,৪৯০/= কোটি টাকা।
————————————-
সর্বমোট=৩,৯২,৪৯০/= কোটি টাকা।
অতএব, ঘাটতি-২,১১,১৮১ কোটি টাকা। অনুমিত বিদেশী অনুদানের কথা বাদ দিলে বাজেট ঘাটতি দাঁড়ায়-২,১৪,৬৮১/= কোটি টাকায়। আর এ ঘাটতি পূরনের জন্য সরকারকে হাত বাড়াতে হয় দেশীয় ব্যাংকের উপর ও বিদেশী ঋণের উপর। দেশীয় ঋণ তথা ব্যাংকের টাকা এভাবে যদি সরকারই ব্যবহার করে, তবে শিল্প উদ্যোক্তরা বা ব্যবসায়ীরা তাদের মূলধন কোথায় পাবে? এতে দেশের শিল্পায়ন ও ব্যবসা বানিজ্যের গতি হ্রাস পাবে। উন্নয়ন স্থবির হয়ে পড়বে। বাড়বে বেকারত্ব। সামাজিক অস্থীরতা। অধিকন্তু ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে আয়কর বিধানের যে পরিবর্তন তথা সংশোধন করা হয়েছে এর ফলশ্রæতিতে কাংখিত আয়কর সংগ্রহ সম্ভব হবে না। আয়কর আইন সর্বসময়ে হতে হয় সহজে আদায়যোগ্য এবং এছাড়া ব্যক্তিগত নীট পরিসম্পদের উপর সারচার্জ হওয়া উচিৎ নি¤œরূপঃ-
১। নীট পরিসম্পদের মূল্যমান ৩ কোটি টাকা পর্যন- ০%
২। নীট পরিসম্পদের মূল্যমান ৩ কোটির উর্ধে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত- ১০%
৩। নীট পরিসম্পদের মূল্যমান ১০ কোটির উর্ধে ২০ কোটি টাকা পর্যন্ত-২০%
৪। নীট পরিসম্পদের মূল্যমান ২০ কোটির উর্ধে ৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত-৩০%
৫। নীট পরিসম্পদের মূল্যমান ৫০ কোটির উর্ধে হলে- ৩৫%
এ বিষয়ে আমার মতামত হলোঃ-
১। নীট পরিসম্পদ বিষয়ে যে কথাটি বলা হয়- তাহলো ব্যক্তির মূল সম্পত্তির বর্তমান বাজার মূল্য। উদাহরন হিসেবে বলতে হয়- আমার এক আত্মীয়ের পুরান ঢাকার একটি বাড়ির সাড়ে তিন কাঠা জমি মাত্র ১৮ হাজার ১ টাকায় কেনা আজ থেকে প্রায় ৫৫ বছর আগে যার বর্তমান মূল্য নিদেনপক্ষে ৭ কোটি টাকা। তারা নিজেরা বসবাস করে যে ভাড়া পান তার উপর প্রাপ্ত ভাড়ার উপর অর্পিত আয়করের উপর যদি ১০% সারচাজ দিতে হয় তখন ঐ সম্পত্তিটিই মালিকের নিকট দায়ভার হিসেবে বর্তায়। সুতরাং দশ কোটি হতে ১০০ কোটি টাকার নীট সম্পদের উপর সারচার্জ হওয়া উচিত ১০ কোটি হতে ২০ কোটি পর্যন্ত ১০% ২০ কোটি হতে ৫০ কোটি পর্যন্ত ১৫% এবং তার উর্ধে সর্বোচ্চ ২০%।
তাছাড়া বাজেট বরাদ্দের খাতওয়ারী বরাদ্দের যে চিত্র দেখলাম- তা দেশ ও জাতির স্বার্থে পুনর্বিবেনার দাবী রাখে। যেমন-
খাত বরাদ্দের হার হওয়া উচিত
১। জন প্রশাসন ১৮.৭% ১২.৫%
২। শিক্ষা ও প্রযুক্তি ১৫.৭% ২০%
৩। যাতায়াত-পরিবহন ১১.৯% ৭.৫%
৪। গৃহায়ন ১.১% ২.৫%
৫। প্রতিরক্ষা ৬.২% ৭.৫%
৬। স্বাস্থ্য ৫.৪% ৭.০%
৭। স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ৭% ১০%
৮। কৃষি ৫.৩% ৭.৫%
৯। সামাজিক নিরাপত্তা ৫.৭% ৬.৫%
১০। শিল্প ০.৮% ৩.০%
১১। জনসংখ্যা ও নিরাপত্তা ৪.৮% ৪.৮%
১২। জ¦ালানী ও বিদ্যুৎ ৪.৫% ৩.০%
১৩। ঋণের সুদ পরিশোধ ১১.৪% ১১.৪%
১৪। স্বাস্থ্য ৫.৪% ৭.৫ঁ
১৫। বিবিধ ব্যয় ০.৮% ০.৮%
আবার পাবলিকলি ট্রেডের কোম্পানীর আয়ের উপর ধার্যকৃত কর হার ও বাস্তবতার প্রেক্ষিতে পুনঃ বিবেচনার দাবী রাখে। যেমনঃ-
১। এক ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানীর ক্ষেত্রে সরকারের প্রস্তাবিত আয়করের হার- ২৫%। এক্ষেত্রে হওয়া উচিত-১৭.৫% ;
২। পাবলিকলি ট্রেডে ব্যাংক, বীমা, ফাইনানসিয়াল সার্ভিস গ্রহনকারী ও মার্চেন্ট ব্যাংকের উপর প্রস্তাবিত কর- ৩৭.৫% এর মূলে- ৪০% হওয়া উচিৎ ;
৩। পাবলিকলি ট্রেডেড না হলে কর হার- ৩০% এর স্থলে ২৫% হওয়া উচিৎ ;
৪। পান, বিড়ি, জর্দা ও তামাক জাত দ্রব্য প্রস্তুতকারী কোম্পানসহ মোবাইল ফোন কোম্পানী পাবলিকলি ট্রেডেে না হলে প্রস্তাবিত কর-৪৫% এবং সারচার্জ- ২.৫% এর পরিবর্তে এসব দ্রব্যাদির- প্রস্তুতকারী কোম্পানীর কর হওয়া উচিৎ-৫০% এবং সারচার্জ-২৫% ;
৫। মোবাইল ফোন অপারেটর এবং পাবলিকলি ট্রেডেড কোম্পানীর উপর কর ধার্য-৪০% এর স্থলে কর ৫০% এবং সারচার্জ-২৫% হওয়া উচিৎ ;
৬। এনার্জি ড্রিংক এবং দেশী ও বিদেশী মদের উপর কোপ প্রকার কর ধার্যের বিধান উল্লেখ নেই। অথচ এসব দ্রব্য বিশেষ করে এনার্জি ড্রিংকের উপর কর হওয়া উচিৎ কমপক্ষে ৫০% এবং সারচার্জ-২৫%, আর দেশী বা বিদেশী মদের উপর- কর ২০০% এবং সারচার্জ-১০০% ;
৭। বেসরকারী বিশ^বিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ডেন্টাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং ও তথ্য প্রযুক্তি কলেজের উপর- ১৫% কর ধার্য একেবারে অনৈতিক। এসব প্রতিষ্ঠানের উপর কোন প্রকার অর্পন দেশের মিক্ষা বিকাশের ক্ষেত্রকে সংকুচিত করার সামিল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই হওয়া উচিৎ করমুক্ত। এতে শিক্ষার্থীদের ব্যয়ভার কমে গেলে শিক্ষিতের হার বাড়বে।
২০২১-২০২১ জাতীয় বাজেটে প্রস্তাবিত আয়করের হার নি¤œরূপঃ-
(১) প্রথম ৩ লাখ টাকার উপর কর হার- ০%
(২) পরবর্তী ১ লাখ টাকার উপর কর হার- ৫%
(৩) পরবর্তী ৩ লাখ টাকার উপর কর হার- ১০%
(৪) পরবর্তী ৪ লাখ টাকার উপর কর হার- ১৫%
(৫) পরবর্তী ৫ লাখ টাকার উপর কর হার- ২০%
(৬) অবশিষ্ট মোট আয়ের উপর কর হার- ২৫%
অথচ বর্তমান প্রেক্ষাপটে জীবন-জীবিকার ব্যয়ভার এর বিষয়টি এবারের বাজেটে প্রস্ফুটিত হয়নি। আমার মতে সমাজ রাষ্ট্রের চলমান আর্থিক পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নিয়ে প্রস্তাবটি হওয়া উচিৎ ছিলো নি¤œরূপঃ-
(১) প্রথম ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত কর হার- ০%
(২) পরবর্তী ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত কর হার- ৫%
(৩) পরবর্তী ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত কর হার- ১০%
(৪) পরবর্তী ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত কর হার- ১৫%
(৫) পরবর্তী ১০ লাখ বা তার উর্ধে অর্থাৎ ব্যক্তিগত আয়ের সর্বোচ্চ আয়কর ২০% এর বেশী ধার্যকরা অনুচিৎ।
দেশের আভ্যন্তরীন উৎস, দেশী ও বিদেশী ঋণ নির্ভর এ বাজেট পরিকল্পনাবিদদের একটি কথা স্মরন রাখা উচিৎ যে, সম্পদ অর্জনের চেয়ে রক্ষনই সবচে’ বেশী বিজ্ঞজনচিত। আর ধার করে- বিরিয়ানী খাওয়ার চাইতে পান্তাভাতই উত্তম। রাষ্ট্রীয় বাজেটের টাকা প্রকল্প প্রনেতারা যেভাবে লুট করছে, এতে শকূনরাও লজ্জা পায়। জনগনের শ্রম ও ঘামে অর্জিত অর্থ যথার্থভাবে ব্যায়ীত হোক- জনগন তাই আশা করে।
-এ্যাডভোকেট আলহাজ¦ মোঃ আব্বাস উদ্দিন
-বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।